শুক্রবারের দিনটা খুব খারাপ। স্কুল থাকে না, বাবার অফিসও থাকে না। প্রথমটায় সমস্যা না থাকলেও দ্বিতীয়টা গুরুতর। বাপ বাসায় থাকা মানে ঘড়ির কাটার সাথে সারাদিন কাটানো। বেলা ১২ টার মধ্যে গোসল, তারপর নামাজ। নামাজ থেকে ফিরে ভাত এবং বিকালে ভাতঘুম। বাইরে দৌড়ঝাঁপ আপাদত বন্ধ। বাপের চোখে পড়লে ওই মুহুর্তে কিছু বলবে না, কিন্তু রাতে পড়ার টেবিলে সাইজ! মাঝে মধ্যে মনে হয় সপ্তাহের সাতদিন বাপের অফিস থাকলে কি সমস্যা? আরো গুরুতর ঘটনা আছে শুক্রবারে, সেটা অবশ্য মাসে একবার ঘটে। বাপের সাথে তার পরিচিত নাপিতের কাছে চুল ছাটা। বেটা নাপিতও জন্মের হারামি। এতো কই সামনের চুল একটু বড় রাখতে। না দেয় মুথা মাইর্যা। বাপে আবার মঝে মধ্যে ডিরেকশন দেয়, “ছোট, আরেকটু হবে, আরে সামনের চুল বড়ো ক্যান, ফাজিল পোলাপাইনের মতো”। তারপর এক সপ্তাহ চুল হারানোর শোঁকে কাটানো।
বাপের আরেকটা প্রিয় কাজ হলো শরীরে কোন ফোঁড়া হলে টিপে এর বারোটা বাজানো। হাজার দোহাই দিলেও শুনবে না। পুরাই আজিব!
ওনার আরো প্রিয় কাজের মধ্যে একখান হলো, পড়ার টেবিলে আমারে বেতানো। কত বেত যে গোপনে ভাঙ্গছি। লাভ হয় নাই, চকচকে ডান্ডি সে যোগাড় করে নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে ফিরে এসেছে অফিস থেকে।
প্রাইমারিতে পড়ার সময় তার আরেকখান প্রিয় কাজ ছিলো। প্রত্যেক পরীক্ষার পর বাসায় এসে দুপুরে আবার সেই প্রশ্নে পরীক্ষা দিতে হতো। দেখা যেত স্কুলে কোন প্রশ্নের উত্তর হয়তো ঠিক লিখছিলাম, সেটা বাসায় লেখলাম ভুল। আবার স্কুলে ভুল কইর্যা আসছি, বাসায় লেখলাম ঠিক। বাসায় পরীক্ষক বাপ। প্রথমে খাতায় মার্কিং , পরে শরীরে। ২য় দফায় স্কুলে খাতা দেয়ার পর বাসার খাতা ও স্কুলের খাতা নিয়ে আরেক দফায় শরীর মার্কিং। এই ভয়ে বাপের সাইন নকল করে কতো যে খাতা জমা দিয়ে দিয়েছি। আর বাপ জিগাইলে কইতাম, “খাতা দেয় নাই”।
টিভি দেখাতো আরেক যন্ত্রণার ব্যাপার ছিলো। রাত দশটার পর টিভি ছাড়া যাবে না। হারকিউলিস, এক্স ফাইলস হতো রাত দশটার খবরের পর। প্রত্যেক সপ্তাহে দুইটার মধ্যে একটা মিস হতো। আর সেটা দেখার জন্যে কী সাধনা যে করা লাগতো!
এইচ এস সি পরীক্ষার মধ্যে দাদা মারা গেলেন। ম্যাথের আগে দশ দিনের মতো বন্ধ। প্রথম ক’দিন তাইরেনাইরে করে পার। আর মোটে আছে চার দিন। দুপুরে কেবল বই নিয়ে বসেছি, ৩১ শে মে, খবর আসলো দাদা মারা গেছেন। বই ফেলে পুরো ফ্যামিলি রওনা হলাম গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। দাদার শেষ গোসল করালেন বাবা আর আমার এক ফুফাত ভাই মিলে। বাড়ি ভর্তি লোকজন। কেউ কাঁদতে গেলে বাবা ধমকাচ্ছেন তাকে। রাত শেষে ভোর এলো। বাড়ির মসজিদের বারান্দায় দাদার লাশ নিয়ে বাবা বসে থাকলো সারা রাত। ফজরের আজান হয়ে গেছে, ঘুমিয়েছিলাম মসজিদের ভেতরে। বাবা ডেকে বললো, “যাও ওজু করে এসে নামাজ পড়ো”। নামাজ শেষে মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। সামনেই বাবা বসে আছেন নামাজের আসনে। হঠাৎ মনে হলো তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। এর মানে বাবা কাঁদছে। দাদা আমার অতি প্রিয় একজন মানুষ ছিলেন। কিন্তু সে সময় তার কথা আর আমার মাথায় রইলো না। বাবা কাঁদছে দেখে নিজেকে আমি সামলাতে পারলাম না। বাবা কেন কাঁদবে? তাকে কখনো কাঁদতে দেখি নি। আমি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। আমার একটাই কথা, আমার বাপ ক্যান কাঁদবে, ক্যান কাঁদবে?
তাকে কখনো মুখে বলিনি, ভালোবাসি। কোনদিন হয়তো বলাও হবে না। কারণ এসব আমার দ্বারা হয় না, কিন্তু আমার সামনে আমার বাপ কেন কাঁদবে। হঠাত সেদিন বুঝলাম, এই পাষাণের মুখোশ পড়া লোকটাকে আমি কী প্রচন্ড ভালোবাসি।
২২ জানুয়ারী - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪